আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও ফিন-বি আন্তর্জাতিক সম্মেলন

Updated on 22/07/2019 - By InM - No Comments

ড. ফারহানা নার্গিস| ২১:০৮:০০ মিনিট, জুলাই ২২, ২০১৯

 

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে সব বাধা অতিক্রম করে বাংলাদেশ স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের সব ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করে আসছে। বর্তমানে বাংলাদেশকে উন্নয়নের একটি রোল মডেল হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে; বাংলাদেশে বর্তমানে দারিদ্র্যের হার ২২ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০১০ সালে প্রায় ৩২ শতাংশ ছিল। আরো গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, অতিদারিদ্র্যের হার শতকরা ১২ শতাংশে নেমে এসেছে, যা ২০১০-এ ছিল প্রায় ১৮ শতাংশ। এ অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সঙ্গে নিয়ে কীভাবে বাংলাদেশকে একটি উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা যায়, সে লক্ষ্যে দেশের নীতি ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে, যার একটি মূল লক্ষ্য হচ্ছে সবার জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা।

একটি দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিতে হলে সবার জন্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তি অন্যতম পূর্বশর্ত। ২০১২ সালে উন্নত বিশ্বে প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিজস্ব অ্যাকাউন্ট ছিল ৯১ শতাংশ মানুষের, যা উন্নয়নশীল দেশের ক্ষেত্রে ছিল মাত্র ৪১ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৫০ শতাংশ লোকের প্রাতিষ্ঠানিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অ্যাকাউন্ট অথবা নিজস্ব মোবাইল অ্যাকাউন্ট আছে। ব্যাংক, ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান, পোস্ট অফিস, সমবায় সমিতি এবং বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো দুই যুগ ধরে এ প্রেক্ষাপটে কাজ করে যাচ্ছে, যাতে আর্থিক সেবা সবার কাছে সহজলভ্য হয়। আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে নিশ্চিত করার মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং সেই সঙ্গে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যগুলো (এসডিজি) অর্জনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান প্রধান লক্ষ্য, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যারা অন্তর্ভুক্ত নয় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে আর্থিক সেবার আওতায় নিয়ে আসা। ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে সাতটির জন্য ‘আর্থিক অন্তর্ভুক্তি’কে খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং এটা আমাদের জাতীয় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে, অর্থাৎ দারিদ্র্যমুক্ত উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়া এবং আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমতাভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ সক্রিয় অনুঘটক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

সাধারণভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বলতে বোঝায় প্রতিযোগিতামূলক আর্থিক বাজারের মাধ্যমে সর্বনিম্ন ঝুঁকিসহ সবার জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে আর্থিক সেবাগুলোর প্রাপ্যতা এবং সবার সম্পূর্ণ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। অন্যভাবে বলা যায়, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি হলো যেখানে ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা অনুসারে প্রয়োজনীয় ও সাশ্রয়ী মূল্যের আর্থিক পণ্য ও পরিষেবা গ্রহণ ও লেনদেনের সুযোগ থাকে এবং এ লেনদেন সহজে, দায়িত্বপূর্ণভাবে ও টেকসই উপায়ে করা সম্ভব হয়। এক্ষেত্রে আর্থিক সেবাগুলো বলতে সাধারণত সঞ্চয়, ঋণ, বীমা ও পেমেন্ট (মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস-এমএফএস)—এ চার পণ্যের যেকোনো একটিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অন্তর্ভুক্ত থাকাকেই আমরা আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বলি। সুতরাং, আমাদের এমন অর্থ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেখানে প্রতিটি ব্যক্তি স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ চার পণ্যের কোনো না কোনোটিতে সরাসরি যুক্ত থাকবে। আমাদের জনগোষ্ঠীর অনেক অংশই সঞ্চয় করছে কিন্তু তা অপ্রাতিষ্ঠানিক উপায়ে। এর অর্থ, তাদের চাহিদা রয়েছে কিন্তু উপযুক্ত সুযোগের অভাবে তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে লেনদেন করতে পারছে না। ফলে তারা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারছে না এবং এরূপ প্রতিষ্ঠানের নানা কার্যক্রম থেকে বিচ্ছিন্ন রয়ে যাচ্ছে। এ পিছিয়ে পড়া বিচ্ছিন্ন জনগোষ্ঠীকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃত্বে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পথে যাত্রা হয় ২০০০ সালে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মাঝে সঞ্চয়ের অভ্যাস বাড়ানো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, বিশেষ করে নারীদের ব্যবসা সম্প্রসারণ এবং সবার মধ্যে আর্থিক সচ্ছলতা নিয়ে আসা। তাছাড়া অ্যালায়েন্স ফর ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশনের (আফি) প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি হিসেবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেতৃস্থানীয় ভূমিকা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। ব্যাংকের শাখা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বর্তমানে গ্রাম ও শহরের অনুপাত ১:১। ফলে কৃষক, স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের জন্য ১০ টাকার অ্যাকাউন্ট সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি আরো কিছু পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ছাড়াও বেশকিছু সরকারি-বেসরকারি সংস্থা আর্থিক অন্তর্ভুক্তির জন্য কাজ করে যাচ্ছে। কীভাবে এবং কী উপায়ে আর্থিক পণ্যগুলো এ সুবিধাবঞ্চিত জনগণের চাহিদা অনুযায়ী প্রস্তুত করা যায়, সেই প্রেক্ষাপটে ব্র্যাক, গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে ব্যাপকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া সরকারের এটুআই প্রকল্পের মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তীকরণের বিভিন্ন কাজ চলমান রয়েছে।

আমাদের দেশে বর্তমানে ডিজিটাল আর্থিক অন্তর্ভুক্তীকরণ ব্যবস্থার অগ্রগতি ব্যাপকভাবে প্রশংসনীয়। বর্তমানে ২৮টি ব্যাংক এমএফএসের মাধ্যমে আর্থিক সেবা প্রদানের অনুমতি লাভ করেছে, সুতরাং এদের কাজের অগ্রগামিতার উদ্দেশ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। যেমন এমএফএসের প্রসার দেশের বাইরে করা হলেও আমাদের রেমিট্যান্সের পরিমাণও বেড়ে যাবে। অনুরূপভাবে, ডিএফএস সেবাকে যদি ন্যূনতম খরচে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা যায়, তবে সুবিধাবঞ্চিত দরিদ্র জনগোষ্ঠী সহজেই এ সেবাগুলো গ্রহণ করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে।

এ প্রেক্ষাপটে ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএনএম) ৩০-৩১ জুলাই ‘থ্রি-ডি সেমিনার হল’, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট ফার্মগেট, ঢাকায় দুই দিনব্যাপী একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করেছে। সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে কীভাবে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় আনা যায়, কীভাবে আর্থিক সেবাগুলো সাধারণ জনগণের মাঝে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন করা যায়, তা পর্যালোচনা করে দেখা এবং কিছু কার্যকর নীতি ও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া।

সম্মেলনে কয়েকটি বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হবে, যেমন বাংলাদেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির বিবরণ: শক্তি ও দুর্বলতা; আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা: প্রতিকূলতা ও অসমতা; নিয়ন্ত্রক এবং নীতিমালাসংক্রান্ত অবকাঠামো: চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ; প্রযুক্তি প্রবর্তন, এজেন্ট ব্যাংকিং এবং ডিজিটাল আর্থিক সেবা; আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ব্যবসায়িক মডেল নকশাকরণ: প্রবর্তনের পন্থা এবং সফল উদাহরণ। এ সম্মেলন আইএনএমের ফিন-বির (আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ) বিশেষ কার্যক্রম হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে। ফিন-বি নেটওয়ার্কটি সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ব্যাংক; বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান; এনজিও-এমএফআই; আর্থিক খাতসংশ্লিষ্ট নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক প্রতিষ্ঠানের পরামর্শে পরিচালিত হচ্ছে। ফিন-বি প্লাটফর্মের একটি প্রধান উদ্দেশ্য আর্থিক অন্তর্ভুক্তির দক্ষ ও কার্যকর উপায় সম্পর্কে সচেতনতা ও জ্ঞান সৃষ্টি করা, যাতে দ্রুত দারিদ্র্য বিমোচন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নসহ সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা সম্ভবপর হয়।

এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি, আর্থিক সংস্থা তথা ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি, এনজিও-এমএফআই, আর্থিক নিয়ন্ত্রক অর্থাৎ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো, উন্নয়ন গবেষক, নীতিনির্ধারক ও অন্যান্য আগ্রহী এ দুই দিনব্যাপী আলোচনায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছেন। সম্মেলন থেকে আহরিত জ্ঞান বাংলাদেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্য আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এ প্লাটফর্ম কর্তৃক আয়োজিত সম্মেলনের আলোচনা থেকে গৃহীত সুপারিশ জাতিসংঘের এসডিজি অর্জনে এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কিছু লক্ষ্য, যেমন টেকসই দারিদ্র্য বিমোচন, জলবায়ু পরিবর্তনের স্থায়ী ব্যবস্থাপনা, নারীর ক্ষমতায়ন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন ও অন্যান্য উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিতেও সহায়তা করবে। সর্বোপরি, আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে এ সম্মেলন থেকে একটি সমুন্নত দিকনির্দেশনা পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

 

ড. ফারহানা নার্গিস: রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএনএম)


The Institute for Inclusive Finance and Development (InM) is registered as an independent non-profit institution under the Societies Registration Act 1860.
The Institute works for developing the overall capacity of the financial sector and strengthening the links between the financial and real sectors through undertaking research, training, education, knowledge management and other programmes in priority areas including inclusive finance, microfinance, poverty and development.


Contact Us
+880 1729 072 881
inm.org.bd@gmail.com / info@inm.org.bd
House #50 (5th Floor), Road #8, Block-D, Niketon, Gulshan-1, Dhaka-1212, Bangladesh.
© 2024 InM
Design by
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram