ড. ফারহানা নার্গিস
নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশে পৌঁছতে হলে আমাদের কৃষিখাদ্য খাতে একটা বড় পরিবর্তন প্রয়োজন। আর কৃষিখাদ্য খাতে পরিবর্তন মানে শুধু খাদ্যের পর্যাপ্ততা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ নয়, সেই সঙ্গে খাদ্যের গুণগত মানও সুরক্ষা করা। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি জনগণের খাদ্য উৎপাদনের জন্য ব্যবহূত জমির পরিমাণ প্রায় ১ দশমিক ৮ কোটি একর এবং মাথাপিছু আবাদি জমির পরিমাণ শূন্য দশমিক ১৪ একর। এখন থেকে আগামী ২১ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের লোকসংখ্যা প্রায় ২০ কোটির কাছাকাছি পৌঁছবে, যেখানে চাষযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব নয়; বরং অকৃষি কাজে জমি ব্যবহার অনেকটাই বাড়বে, ফলে কৃষিজমির পরিমাণ আরো কমে আসবে। ফলে এই বাড়তি চাপ বহন করার জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত, সেটা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চমধ্যম আয়ের দেশের কাতারে পৌঁছতে হলে কৃষিখাদ্য খাতের উন্নয়ন দর্শনটা কী হবে, সেটাই এখন আমাদের ঠিক করতে হবে। ভিশন হতে হবে ‘এমন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক কৃষি খাত প্রতিষ্ঠা করা, যা কিনা নিরাপদ, লাভজনক ও টেকসই কৃষিখাদ্য ব্যবস্থার পাশাপাশি পুষ্টিকর খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করে এবং একই সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে প্রয়োজনীয় সংযোগ রক্ষা করে একটি উচ্চ আয়ের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হয়। ২০৪১ সালের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কিছু উল্লেখযোগ্য সূচক হলো, মধ্যমাত্রার দারিদ্র্য ৫ শতাংশের নিচে এবং অতিদরিদ্রের হার শূন্যে নেমে আসতে হবে; ২০৩০ সালের মধ্যে আমাদের উচ্চমধ্যম আয়ের দেশে এবং ২০৪১-এ উচ্চ আয়ের দেশে পৌঁছতে হবে; বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যেখানে জলবায়ু পরিবর্তন এবং অন্যান্য পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা রাখা যায়, একই সঙ্গে কৃষিপণ্যের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং ভবিষ্যতের খাদ্য-পুষ্টির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কৃষিতে দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন প্রবর্তন করতে সক্ষম হতে হবে। পাশাপাশি রফতানিমুখী উৎপাদনসহ শিল্পায়নের প্রসার ঘটানোই হবে ভবিষ্যতের কাঠামোগত রূপান্তরের চালক।
এরই প্রেক্ষাপটে ২০৪১ সালের জন্য কৃষি খাতের লক্ষ্য স্থির করার ক্ষেত্রে প্রধানত চারটি বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। প্রথমত, উন্নত খাদ্য ও পুষ্টি সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ। দ্বিতীয়ত, প্রতিযোগিতামূলক পণ্য উৎপাদন ও উন্নত বাজারজাতের ব্যবস্থা করা এবং কৃষিক্ষেত্রে ক্লাস্টার ও ভ্যালু চেইনের বিকাশ করা। তৃতীয়ত. ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের স্বার্থ মাথায় রেখে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা জোরদার করার পাশাপাশি চাহিদা সম্প্রসারণমূলক সেবাগুলোর প্রতি গুরুত্ব প্রদান। এক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীভূতকরণের ভূমিকা অনস্বীকার্য। চতুর্থত, চাল, শাকসবজি, ফলমূল ও মসলা, প্রাণিজ প্রোটিন, দুগ্ধজাত পণ্য, মাছ এবং অন্যান্য পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে। যা কিনা আমাদের সীমিত জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি, বৃহৎ পরিসরে খাদ্য উৎপাদন এবং যান্ত্রিক চাষাবাদ ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমেই অর্জন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং গুরুত্ব অনুযায়ী কৌশল নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য সুযোগ-সুবিধাগুলো হতে হবে বাজারকেন্দ্রিক এবং পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দায়ী এজেন্টদের চিহ্নিত করে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে। এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা, স্থানীয় সার সরবরাহকারী এবং এ ধরনের আরো যারা আছেন, সবাইকে একীভূত করা যেতে পারে। সম্প্রসারিতকরণের সময় সঠিক পয়েন্ট অর্থাৎ কোথা থেকে শুরু করব তা ঠিক করতে হবে। কৃষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে কৃষকদের বিশেষ করে প্রান্তিক কৃষকদের অবস্থার উন্নয়ন হয় এবং আমরা শুধু Inclusive Growth-B নয়, Inclusive Agricultural Growth অর্জন করতে পারি ।
এসডিজির লক্ষ্যমাত্রাগুলো সঠিক সময়ে অর্জন করার জন্য কৃষি খাতকে এককভাবে না দেখে ম্যাক্রো অর্থনীতির সঙ্গে সমন্বিত অবস্থায় দেখা ভীষণ জরুরি। এসডিজির একটি মূল লক্ষ্য হচ্ছে Leave no one behind—সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, কাউকে পিছিয়ে রাখা যাবে না। সুতরাং সবাইকে নিয়েই যদি আমরা উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে চাই তাহলে কৃষি খাতে যারা আছেন, যেমন ছোট জেলে, প্রান্তিক চাষী, এদের সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এই এগিয়ে যাওয়ার পথে আমাদের অনেক প্রতিবন্ধকতারও সম্মুখীন হতে হবে। যেমন প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, কীভাবে এদের পুষ্টিকর খাদ্যের নিশ্চয়তা দেয়া যায়, সে বিষয়টি দেখতে হবে। এক্ষেত্রে আমাদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির প্রাপ্যতা নিশ্চিতকরণের পাশাপাশি এর গ্রহণযোগ্যতাও নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে কৃষি সম্প্রসারণ ঘটাতে হবে। জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি কীভাবে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে শ্রম উৎপাদনশীলতা বাড়ানো যায়, সেটাও ভেবে দেখতে হবে। যেমন কৃষকদের জন্য কৃষিঋণ কার্ডের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিছুু ব্যাংক এরই মধ্যে কৃষিঋণ কার্ড চালু করেছে। মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের প্রযুক্তিগত শিক্ষা সম্প্রসারণের পাশাপাশি উপযুক্ত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সুতরাং এসব কার্যক্রমের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করে কৃষি খাতকে আরো কীভাবে সম্প্রসারিত করা যায়, তা ভাবার সময় এসেছে।
গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতির পরিবর্তনের জন্য শহর ও গ্রামের সংযোগ বৃদ্ধির ভূমিকা অনস্বীকার্য। সেজন্য কৃষিতে এবং কৃষির বাইরে কর্মসংস্থানের সুবিধা বাড়াতে হবে। সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের ভূমিকাও বাড়াতে হবে। কীভাবে দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে আমাদের যুবসমাজকে কৃষি খাতে যুক্ত করা যায় এবং গ্রামীণ অকৃষি কাজের পরিধি বাড়ানো যায়, সেটা ভেবে দেখতে হবে। নারী কৃষকদের উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি উদ্ভাবনীমূলক প্রাতিষ্ঠানিক চুক্তির মাধ্যমে কীভাবে গ্রামীণ সেবাগুলো সীমিত সম্পদ ব্যবহার করে শহরে পৌঁছে দেয়া যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে। পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্যের নিশ্চয়তার পাশাপাশি কৃষি খাতে টেকসই উৎপাদন নিশ্চিত করতে হবে এবং একই সঙ্গে পরিবেশগত পরিবর্তনগুলোও বিবেচনায় রাখতে হবে। কৃষিখাদ্য খাতের পরিবর্তনটাকে যদি আমরা হলিস্টিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতে পারি তাহলে এ খাত স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পাশাপাশি এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে অন্যান্য খাতকেও সহায়তা দেয়া সম্ভব হবে।
ড. ফারহানা নার্গিস: রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএনএম)