মহামারীর ঝুঁকি ও ক্ষুদ্র অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা

Updated on 01/10/2020 - By InM - No Comments

ড. ফারহানা নার্গিস
সেপ্টেম্বর ২৯, ২০২০
অতীতকাল থেকেই বাংলাদেশের ক্ষুদ্র অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানগুলো (এমএফআই) স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় অসামান্য সক্ষমতা দেখিয়ে আসছে। কভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাবের ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটা অনস্বীকার্য যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দিনমজুর ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীগোষ্ঠী, যারা দৈনিক আয়ের ওপর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বাধার কারণে দেশের বেশির ভাগ পরিবারের আয় কমে গেছে, বিশেষত দরিদ্র পরিবারগুলোর যারা অপ্রাতিষ্ঠানিক অকৃষিকাজের (যেমন নির্মাণকাজ ও গ্রামীণ অকৃষি খাত) ওপর নির্ভরশীল। এই পরিবারগুলোর বেশির ভাগই তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য এমএফআইগুলোর ঋণ ও অন্যান্য কর্মসূচি থেকে সহায়তা লাভ করে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে এমএফআইগুলোর জন্য একটি বড় সমস্যা হচ্ছে ভবিষ্যৎ কার্যক্রম নির্ধারণ করা। কারণ আগামী দিনগুলোয় ঠিক কত সময়, কত শক্তিশালীভাবে কভিড-১৯-এর সংকট অব্যাহত থাকবে, তা অনেকটাই অজানা। সুতরাং এ পরিস্থিতিতে কভিড-১৯-এর প্রভাব থেকে উত্তরণের জন্য এমএফআইগুলো বেশ কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করতে পারে।

এমএফআইগুলোর জন্য নগদ অর্থপ্রবাহের অন্যতম নির্ভরযোগ্য উৎস হচ্ছে ঋণ পরিশোধ (repayment of loan)। এর পরই রয়েছে ঋণগ্রহীতার সঞ্চয়, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ। অন্যদিকে অর্থের প্রধান প্রধান ব্যয়ের খাত হচ্ছে ঋণ বিতরণ, ঋণদাতার ঋণ পরিশোধ, কর্মীদের বেতন প্রদান এবং অফিস ও অন্যান্য ব্যয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে ঋণ পরিশোধের মতো গুরুত্বপূর্ণ উৎসটি সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ব্যাংকগুলোও এমএফআইগুলোকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে একটা ‘wait and watch mode’-এ রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। অতীতে ক্ষুদ্র অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ঋণ পরিশোধের হার তুলনামূলকভাবে দ্রুতগতিতে (কয়েক মাসের মধ্যে) পুনরুদ্ধার করতে পেরেছিল। বর্তমানেও এটা করা সম্ভব হতে পারে, যেমন ক্ষুদ্র অর্থায়ন ঋণ আরো ভালোভাবে তদারক করা, বিশেষ করে অর্থায়নের পর উৎপাদনশীল কার্যক্রম শুরু হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে। এক্ষেত্রে কয়েক মাসের জন্য নতুন ঋণ বিতরণ কার্যক্রম যথাসম্ভব সীমিত করে তহবিল সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা নেয়া যেতে পারে, যা এমএফআইগুলোর নগদ অর্থপ্রবাহ সঠিকভাবে পরিচালনা করার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে।

অন্যদিকে এমএফআইগুলোকে কর্মীদের বেতন, অফিস ব্যয়, ঋণদাতাদের ঋণের কিস্তি এবং অন্যান্য নিয়মিত ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। যদিও বড় এমএফআইগুলোর জন্য এটি কোনো বড় সমস্যা না-ও হতে পারে। তবে ছোট ও মাঝারি এমএফআইগুলোর টিকে থাকার জন্য এটি বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে আরো ব্যয়সাশ্রয়ী কীভাবে হওয়া যায়, সে বিষয়গুলো বিবেচনা করে বাস্তবসম্মত ব্যবস্থা নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে এমএফআইগুলোর জন্য।

এমএফআইগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মহামারীর পরে তাদের কার্যক্রমের টেকসইতা সুরক্ষা করা। তবে বর্তমান নভেল করোনাভাইরাস সংকটের জন্য, সংকটের পরিমাণ এবং সময়কালের ওপর নির্ভর করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসার জন্য ১২ থেকে ১৮ মাস সময় হয়তো লাগতে পারে; যা পুরোটাই কিন্তু অনিশ্চিত। সংক্রমণের তীব্রতা কমে গেলে এবং এমএফআইয়ের মাঠকর্মীরা অবাধে চলাচল করতে পারলে দ্রততার সঙ্গে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পাওয়ার জন্য এখনই কৌশল নির্ধারণ করতে হবে।

অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে ক্ষুদ্র অর্থায়ন গ্রহীতারা সাধারণত তাদের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপ পুনরুদ্ধারে বেশ দ্রুত অগ্রসর হতে পারে। এমএফআইগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ পোর্টফোলিও সাধারণত পুরোপুরি কার্যক্রম শুরু হওয়ার পরে দুই-তিন কোয়ার্টারের মধ্যে হ্রাস পায়। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে হয়তো এমএফআইগুলোকে কিছু কুঋণের মুখোমুখি হতে হবে, ঋণের চাহিদা বেড়ে গেলে (যেহেতু গ্রাহকদের তাদের ব্যবসা পুনঃস্থাপনের জন্য তারল্যের প্রয়োজন) এই লোকসানের ক্ষতিপূরণ করা খুব একটা কষ্টকর হবে না।

কিছু ঋণগ্রহীতার অবশ্য ঋণ পরিশোধের জন্য অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন হতে পারে, যার জন্য ঋণ পরিশোধের সময়কাল কিছুটা বাড়ানো প্রয়োজন হতে পারে। এজন্য কিস্তিগুলো কিছুটা নমনীয় করা যেতে পারে। তবে অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে এটা বলা যায় যে বেশির ভাগ বকেয়া ঋণ এমএফআইগুলোয় ফিরে আসবে। এমএফআইগুলো এরই মধ্যে গ্রাহকদের আর্থিক তারল্যের চাপের সঙ্গে মোকাবেলার কার্যকর অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে নিঃসন্দেহে তাদের কৌশল নির্ধারণ করতে সহায়তা করবে।

নভেল করোনাভাইরাস থেকে সংক্রমণের আশঙ্কা নিঃসন্দেহে এমএফআইগুলোর মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের মনোবল ও কাজের দক্ষতায় বেশ প্রভাব ফেলেছে। এই মানসিক শঙ্কা দূর করার জন্য এমএফআইগুলোকে কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা যেমন স্বাস্থ্যনিরাপত্তা উপকরণ সরবরাহ করা, স্বাস্থ্য বীমা অথবা অন্যান্য সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া উচিত হবে।

মাঠকর্মীদেরও তাদের নিজ নিজ কর্ম এলাকায় মহামারীটির অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হতে হবে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। সিনিয়রদের মাঠের কর্মীদের গাইড করতে হবে এবং তাদের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে সাংগঠনিক কার্যক্রমের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা কৌশল নির্ধারণের জন্য মাঠ স্তর থেকে প্রতিক্রিয়াগুলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে দ্রুততার সঙ্গে আদান-প্রদানের ব্যবস্থা যথেষ্ট কার্যকর হবে। মাঠকর্মীদের কভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে কার্যকর যোগাযোগকারী এবং তাদের সদস্যদের কাছে রোল মডেল হিসেবে গণ্য করার ব্যবস্থা গ্রহণ যথেষ্ট সুফল আনতে পারে। কর্মীদের নিজের সুরক্ষার পাশাপাশি গ্রাহকদের কাছে সর্বোত্তম অনুশীলনগুলো তুলে ধরার ব্যবস্থা মাঠ পর্যায়ে অধিক ভূমিকা রাখবে।

অতীতে বাংলাদেশের এমএফআইগুলো অনেক চ্যালেঞ্জ ও সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এমএফআইগুলো কিন্তু আরো শক্তিশালী হয়ে তাদের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছে। কোনো সন্দেহ নেই যে কভিড-১৯ ক্ষুদ্র অর্থায়ন খাতের জন্য একটি গুরুতর সংকট। তবে অতীতের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে এই খাত সফলতার সঙ্গে সংকটের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতা ও দক্ষতা অর্জন করেছে। নিঃসন্দেহে ক্ষুদ্র অর্থায়ন প্রতিষ্ঠানগুলো করোনা-পরবর্তী সময়ে আরো দক্ষতার সঙ্গে সারা বাংলাদেশে তাদের লাখ লাখ দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত সদস্যের প্রয়োজনীয় এই সেবা প্রদানের অতীত সাফল্যকে আরো উজ্জ্বলতর করতে সক্ষম হবে।

ড. ফারহানা নার্গিস: রিসার্চ ফেলো

ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএনএম)


The Institute for Inclusive Finance and Development (InM) is registered as an independent non-profit institution under the Societies Registration Act 1860.
The Institute works for developing the overall capacity of the financial sector and strengthening the links between the financial and real sectors through undertaking research, training, education, knowledge management and other programmes in priority areas including inclusive finance, microfinance, poverty and development.


Contact Us
+880 1729 072 881
inm.org.bd@gmail.com / info@inm.org.bd
House #50 (5th Floor), Road #8, Block-D, Niketon, Gulshan-1, Dhaka-1212, Bangladesh.
© 2024 InM
Design by
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram