বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও প্রযুক্তি

Updated on July 31, 2019 - By InM - No Comments
সম্পাদকীয়

বাংলাদেশে আর্থিক অন্তর্ভুক্তি ও প্রযুক্তি

 ড. মোস্তফা কে. মুজেরী , ড. ফারহানা নার্গিস| ২১:২৬:০০ মিনিট, জুলাই ৩১, ২০১৯

  
 

 

অর্থ প্রদান ও লেনদেনই শুধু আর্থিক সেবার অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং সঞ্চয়, ঋণ ও বীমাও এর অন্তর্গত। প্রতিদিনের জীবনযাত্রার মান উন্নত ও আরো সহজতর করার লক্ষ্যে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য। এর মাধ্যমে মানুষ পারিবারিক ও ব্যবসায়িক বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য অর্জনের পাশাপাশি যেকোনো অপ্রত্যাশিত জরুরি পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়ে ওঠে। আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং এর পরিমাণ দ্রুত হারে বেড়েই চলেছে। বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক নেটওয়ার্কের আওতায় অসংখ্য অর্থ লেনদেনকারী সেবাপ্রতিষ্ঠান সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্যমতে, ২০১৮ সালের মার্চে সেলফোন গ্রাহকের সংখ্যা ১৫ কোটি ছাড়িয়েছে। স্মার্টফোনের ক্রমাগত দাম কমার কারণে এ প্রযুক্তি এখন সবার হাতে হাতে পৌঁছে গেছে। ফলে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে। আমাদের দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, যার মধ্যে নিয়মিত মোবাইল ব্যবহারকারী ও অনিয়মিত ব্যবহারকারী রয়েছেন, তাদের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় সাড়ে আট কোটি। আগামী বছরগুলোয় এ সংখ্যা আরো দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাবে, যার মাধ্যমে অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার একটি বিশাল সুযোগ সৃষ্টি হবে।

উন্নত দেশগুলোয় বর্তমানে যেখানে মাত্র ২১ শতাংশ লেনদেন সম্পন্ন হয় নগদ অর্থের মাধ্যমে, সেখানে বাংলাদেশে এখনো বিপুলসংখ্যক আর্থিক লেনদেন হচ্ছে নগদ অর্থের মাধ্যমে। বাংলাদেশ বর্তমানে উন্নত দেশগুলোর উদাহরণ অনুসরণ করে নগদ লেনদেনের পরিমাণ কমিয়ে আনার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ডিজিটাল অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে এবং এরই ধারাবাহিকতায় এখন প্রায় ৬৯ শতাংশ সরকারি অর্থ প্রদান বা প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা লেনদেন ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে হচ্ছে।

একটি হিসাবে দেখা যায়, ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে ব্যক্তিগত অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারের ছয়টি প্রধান সামাজিক সুরক্ষা জাল কর্মসূচিকে কাজে লাগিয়ে প্রতি বছর প্রায় ১৪৬ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় করা সম্ভব। বর্তমানে শুধু ব্যক্তিগত অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে ২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং ব্যবসায়িক লেনদেনের ক্ষেত্রে মাত্র ৩ শতাংশ ডিজিটাল লেনদেন পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সুতরাং ওয়ালেট, পিয়ার টু পিয়ার লেনদেন ও অ্যাপস ব্যবহার করে ভবিষ্যতে মোবাইলের মাধ্যমে লেনদেন করার ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।

যদিও ঋণের ক্ষেত্রে সব শ্রেণীর উদ্যোক্তার মধ্যে ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা (এমএসএমই) ৯৫ শতাংশেরও বেশি অবদান রাখেন, তার পরও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বা অতীতের ঋণের হিসাব না থাকার কারণে তারা ঋণের প্রয়োজনীয়তা ও প্রাপ্যতার মাঝে এক ধরনের বিশাল ব্যবধানের মুখোমুখি হন।

প্রযুক্তিগত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এ ধরনের ঐতিহ্যগত ঋণ ও ঋণের স্কোরিং মডেল আরোপিত বাধাগুলো সহজেই দূর করা সম্ভব। ব্যাংকগুলো এবং ব্যাংকের সঙ্গে সহযোগী ফিনটেক সংস্থাগুলো সমন্বয়ের মাধ্যমে বিকল্প ঋণ ব্যবস্থা চালু করতে পারে, যা ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে গ্রহীতার সময় ও লেনদেনের ব্যয় কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে।

আমাদের দেশে বীমা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির উন্নয়ন খুবই ধীরগতিতে হয়েছে, যার পেছনে প্রযুক্তির বিলম্বিত গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে দায়ী। কিন্তু ক্রমবর্ধমান গ্রাহক চাহিদা এ দৃশ্যপটকে দ্রুত পাল্টে দিচ্ছে। বীমা কোম্পানিগুলো এখন এমন ধরনের সমাধান খুঁজে বের করছে, যা আরো ভালোভাবে গ্রাহকদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে, চাহিদা পূরণ করবে এবং সেই সঙ্গে গ্রাহকদের ধরে রাখতে সক্ষম হবে। উল্লেখ্য, ফিনটেক প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্ভাবনের জন্য অধিক ব্যয় করার প্রবণতা এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা বিশাল সুযোগ সৃষ্টিতে অসামান্য ভূমিকা রাখছে।

এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আর্থিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী কীভাবে উপকৃত হতে পারে? এক্ষেত্রে সম্ভাব্য দুটি উপায়ের কথা বলা যেতে পারে। প্রথমত, লেনদেন খরচ সর্বনিম্ন করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে প্রাতিষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠানে সঞ্চয়ে অভ্যস্ত করা যেতে পারে। ফলে তারা প্রচলিত পদ্ধতিতে বাড়িতে নগদ অর্থ সঞ্চয় না করে অন্তত কোনো একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সঞ্চয় করবে এবং এর সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। দ্বিতীয়ত এবং সম্ভবত আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, যত বেশি মানুষ ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেমের আওতায় আসবে ও লেনদেন করবে, তা পরবর্তী সময়ে তাদের লেনদেনের ইতিহাস সংগ্রহ করে একটি ক্রেডিট প্রোফাইল তৈরিতে সহায়ক হবে। সেই সঙ্গে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ডিজিটাল ব্যাংকিং চ্যানেল তৈরি করবে।

এ প্রসঙ্গে মাইক্রোসফটের সহপ্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের একটি উক্তি উল্লেখ করা যেতে পারে, ‘ব্যাংকিং সেবাগুলো দরকার, তবে ব্যাংকগুলো নয়।’ তিনি আরো বলেছিলেন, ‘দরিদ্র দেশগুলোয় সমতা আনার ক্ষেত্রে ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম যে ভূমিকা রাখতে পারে, তা অন্য কোথাও রাখা সম্ভব নয়।’ সর্বোপরি এ কথা বলা যায়, প্রযুক্তি আর্থিক অন্তর্ভুক্তি প্রক্রিয়াকে চালিত করতে পারে। তবে এ যাত্রাপথে কিছু প্রতিকূলতার সম্মুখীনও হতে পারে। এক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে হলে অবশ্যই উদ্যোক্তাদের নিয়ন্ত্রক দৃশ্যকল্পের বিষয়ে সর্বদা তত্পর থাকতে হবে। তথ্য-উপাত্ত ও আইনের নিরাপত্তার বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকিং ও ঋণের ইকোসিস্টেমের ওপর জোরালো দৃষ্টি দিতে হবে, যাতে গ্রাহকদের সুরক্ষার বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। পাশাপাশি নিয়ন্ত্রণমূলক কাঠামোতে অসদাচরণ ও জালিয়াতির বিষয়টিও সর্বাধিক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।

পরিশেষে গ্রাহকের প্রত্যাশাকে কোনো অবস্থায়ই উপেক্ষা করা উচিত নয়। কারণ গ্রাহকদের নিত্যনতুন প্রত্যাশাই আরো বেশিসংখ্যক অত্যাধুনিক ও সময়োপযোগী পণ্য উদ্ভাবনে সহায়তা করবে এবং সেই সঙ্গে আর্থিক চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে। এক্ষেত্রে কেবল তারাই সাফল্য অর্জন করতে পারবে, যারা অভিনব প্রযুক্তি, নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ ও পরিবর্তনশীল গ্রাহক চাহিদা—এ তিন ক্ষেত্রকে সমন্বয় করে তাদের কার্যপরিকল্পনা তৈরি করে সে অনুযায়ী কাজ করতে সক্ষম হবে।

 

ড. মোস্তফা কে. মুজেরী: নির্বাহী পরিচালক, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএনএম)

ড. ফারহানা নার্গিস: রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফিন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইএনএম)


The Institute for Inclusive Finance and Development (InM) is registered as an independent non-profit institution under the Societies Registration Act 1860.
The Institute works for developing the overall capacity of the financial sector and strengthening the links between the financial and real sectors through undertaking research, training, education, knowledge management and other programmes in priority areas including inclusive finance, microfinance, poverty and development.


Contact Us
+880 1729 072 881
inm.org.bd@gmail.com / info@inm.org.bd
Chetona Tower, 274/4 (8th Floor)
Monipur (60 Feet Road) Mirpur -2, Dhaka-1216, Bangladesh
© 2024 InM
Design by
crossmenu linkedin facebook pinterest youtube rss twitter instagram facebook-blank rss-blank linkedin-blank pinterest youtube twitter instagram