খাদ্য নিরাপত্তা : আমরা কি সঠিক পথে চলছি?

বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়ন ও কাঙ্ক্ষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজি অর্জনে খাদ্য নিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে কয়েকটি ধাপে একগুচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। যার মধ্যে রয়েছে খাদ্যের লভ্যতা বৃদ্ধি, বিশেষ করে দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্যের ভৌত ও অর্থনৈতিক প্রাপ্যতা নিশ্চিত এবং খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা হ্রাস করা। 

১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর ৭ কোটি থেকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ১৬ কোটিতে পৌঁছেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার, সম্পদের সীমাবদ্ধতা ও দীর্ঘমেয়াদে উন্নয়ন সম্ভাবনার ক্ষেত্রে ব্যাপক অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও আমরা উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন অর্জনে সক্ষম হয়েছি। জনগণের মাথাপিছু আয় ক্রমাগত বৃদ্ধির পাশাপাশি মৌলিক মানব উন্নয়ন সূচকের মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও আমাদের সাফল্য অভূতপূর্ব। যদিও দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে এখনো আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। যেমন উচ্চমাত্রার দারিদ্র্য, বৈষম্য বৃদ্ধি ও অনমনীয় খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা।

১৯৯০ থেকে ২০১৬ সাল— এ সময়ে দারিদ্র্যের হার ৬০ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ২৪ শতাংশ হওয়ার ফলে মোট জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ দারিদ্র্যের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেলেও এখনো দেশে প্রায় ৪ কোটি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বসবাস। এটা খানিকটা বিস্মিত হওয়ার বিষয় বৈকি। কারণ বাংলাদেশের মতো একটি দেশ, যেটি কিনা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হয়েছে এবং অদূর ভবিষ্যতে অর্থাৎ ২০৪১ সালে উন্নত দেশের তালিকায় নাম লেখানোর পরিকল্পনা করছে, তার কিনা খাদ্যের মতো একটি মৌলিক বিষয়ে এখনো সমস্যা বর্তমান। সত্যিটা হচ্ছে, এখনো এদেশের লাখো মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি এবং এ সংখ্যা অনেকটা অদৃশ্যমান। কারণ এ মানুষগুলোর বসবাস কেন্দ্রীয় ক্ষমতাবলয় থেকে অনেক দূরে। পরিবারের ভরণপোষণের নিমিত্তে তাদের প্রতিদিন রীতিমতো লড়াইয়ে নামতে হয়। সাধারণত খাদ্যঘাটতির বিষয়টি কালেভদ্রে পত্রিকার শিরোনামে উঠে আসে; কিন্তু এ ধরনের জরুরি অবস্থা ব্যতীত খাদ্যঘাটতি নিয়ে খুব একটা আলাপ হয় না। এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ‘খাদ্য নিরাপত্তা’ জটিল বহুমাত্রিক একটি বিষয়, যা কেবল কৃষি, প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের ওপর মনোযোগ দাবি করে না, বরং এক্ষেত্রে একাধিক সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত। খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান প্রশ্নটি কিন্তু খুব সহজ ও অকপট। আর তা হলো, স্বাস্থ্যসম্মত ও কর্মক্ষম জীবনযাপনের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সব জনগোষ্ঠী প্রয়োজনীয় পুষ্টি পাচ্ছে কিনা?

খাদ্য নিরাপত্তা কী?

সময়ের পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তা ধারণার পরিবর্তন হয়েছে, বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খাদ্য ও পুষ্টি বিষয়ে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিসর অনেকটাই বিস্তৃত হয়েছে। ১৯৬০-এর দশকে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন কিংবা আমদানির মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে খাদ্য সরবরাহ বা প্রাপ্যতার বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হতো।  ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ফুড সামিটে অভ্যন্তরীণ বাজারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য সরবরাহ এবং তার মূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার মধ্যে রাখার ওপর জোর দেয়া হয়। এ সময় অনেক দেশ ‘সবুজ বিপ্লব’-এর মাধ্যমে এ লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে সফল হয়, বিশেষ করে উচ্চফলনশীল জাতের (এইচওয়াইভি) প্রযুক্তির ব্যবহার করে অধিক শস্য উৎপাদনের মাধ্যমে তারা খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়। তবে সবুজ বিপ্লবের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অতি দ্রুত যে বিরাট সাফল্য অর্জিত হয় তাতে সবাই যে লাভবান হয়েছে তা কিন্তু নয়; বিশেষ করে এটি নিম্ন আয়ের দেশগুলো থেকে ক্ষুধা ও অপুষ্টি নির্মূল করতে সক্ষম হয়নি।

সরবরাহ বৃদ্ধির পদ্ধতিকে ঘিরে খাদ্য নিরাপত্তার এ কৌশলটির সবচেয়ে শক্তিশালী সমালোচনা করেছিলেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর অমর্ত্য সেন। তিনি ‘ফুড এনটাইটেলমেন্ট’ ধারণার সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন। এটি তাঁর খাদ্য নিরাপত্তা ও দুর্ভিক্ষবিষয়ক গবেষণার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। বস্তুত ফুড এনটাইটেলমেন্ট এমন ধরনের একটি অর্থনৈতিক ধারণা, যা চারটি মৌলিক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে: ১. উৎপাদনভিত্তিক উপাদান, যা উৎপাদনশীল সম্পদের মালিকানার ওপর নির্ভর করে; ২. বাণিজ্যনির্ভর উপাদান, যেটি খাদ্যের বাজারের ওপর নির্ভরশীল; ৩. স্ব-শ্রমের মাধ্যমে অর্জিত স্বত্ব, যা উৎপাদন ও ব্যক্তিমালিকানাধীন শ্রমশক্তির সুযোগ ব্যয়ের ওপর নির্ভর করে এবং ৪. উত্তরাধিকার ও ক্রয়ক্ষমতার হস্তান্তর, যা সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত ত্রাণ ও ভর্তুকির অন্তর্ভুক্ত। অমর্ত্য সেন জোর দিয়ে বলেন, খাদ্য নিরাপত্তার জন্য শুধু উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যের পরিমাণ পর্যাপ্ত নয়, সব জনগণের খাদ্যের ওপর নিজেদের স্বত্বাধিকার নিশ্চিত করতে তাদের সেই খাদ্যের ওপর এনটাইটেলমেন্ট অর্জন অপরিহার্য। তিনি আরো উল্লেখ করেন, এমনো হতে পারে কোনো খাদ্যঘাটতি না থাকলেও সেখানকার জনগোষ্ঠী খাদ্য অনিরাপত্তার শিকার হতে পারেন এনটাইটেলমেন্ট না থাকার কারণে। তাই খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি কেবল খাদ্যের লভ্যতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং সবসময় সর্বস্তরের মানুষের ভৌত ও অর্থনৈতিকভাবে তাদের প্রয়োজনীয় মৌলিক খাদ্যপ্রাপ্তির ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে।

খাদ্য নিরাপত্তার সর্বাধিক ব্যবহূত ও বিশ্বব্যাপী গৃহীত সংজ্ঞাটি হচ্ছে এমন: ‘দেশের সব নাগরিকের জন্য ভৌত, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পর্যাপ্ত, নিরাপদ ও প্রয়োজনীয় পুষ্টিমানসম্পন্ন খাদ্যে অবাধ অধিকারের নিশ্চয়তা, যা সক্রিয় ও সুস্থ জীবনের জন্য পছন্দের খাদ্য তালিকা-সংক্রান্ত চাহিদা পূরণ করে।’ সংজ্ঞাটি খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক চারটি বিষয়ের ওপর জোর দেয়: ১. খাদ্যের ভৌত লভ্যতা; ২. ভৌত, সামাজিক ও আর্থিকভাবে খাদ্যপ্রাপ্তির ক্ষমতা; ৩. খাদ্যের সদ্ব্যবহার এবং ৪. উল্লিখিত তিনটি মাত্রার স্থায়িত্ব। তাই বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়গুলোকে মূল্যায়নের জন্য এ মাত্রাগুলোর ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা

সাধারণত খাদ্য নিরাপত্তা নিরীক্ষণে সবচেয়ে উপযুক্ত পদ্ধতিটি হচ্ছে, কী সংখ্যক জনগণ ক্ষুধার্ত আছে তাদের সংখ্যা নিরূপণ। এক্ষেত্রে দুটি প্রধান নিয়ামক হচ্ছে: ১. অপুষ্টিতে আক্রান্ত জনগণের সংখ্যা নিরূপণ, ২. বয়সের তুলনায় ওজনহীন শিশুদের ব্যাপকতা গণনা। এই পরিমাপকগুলো বাংলাদেশের যে চিত্র তুলে ধরে তা কিন্তু হতাশাজনক। অপুষ্টিসংক্রান্ত তথ্যগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, ২০০৫ সালে জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ দৈনিক ১৮০৫ কিলো-ক্যালরির কম খাদ্য গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৯০ সালের এর পরিমাণ ছিল ২৮ শতাংশ। বয়সের তুলনায় কম ওজনের শিশুদের পরিসংখ্যানটা আরো বেশি খারাপ অবস্থা তুলে ধরে। ১৯৯০ সালে বয়স ৫ বছরের নিচে এমন শিশুদের স্বাভাবিক ওজনের তুলনায় কম ওজনের হার ছিল ৬৬ শতাংশ, ২০০৯ সালে এটা দাঁড়ায় ৪৫ শতাংশে। ১৯৯২ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে শিশুদের ওজন হ্রাসের প্রবণতা কমে যায়, তবে ২০০৫ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে কম ওজনের হারের ক্ষেত্রে তেমন কোনো উন্নতি হয়নি।

খাদ্যের লভ্যতাজনসংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও খাদ্যের প্রাপ্যতা পরিমাপের ক্ষেত্রে দৈনিক গড় মাথাপিছু ক্যালরি এবং গড় মাথাপিছু প্রোটিন গ্রহণের পরিমাণ ১৯৭০-এর দশকের পর থেকে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। এক্ষেত্রে কৃষির দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি দেশের জনগণের মাথাপিছু খাদ্য গ্রহণের মান উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। এটা ঠিক যে কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আমাদের নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এর মধ্যে যেমন প্রযুক্তিগত শৈথিল্য রয়েছে, তেমনি রয়েছে নীতি ও পরিকাঠামো ঘাটতি, বাজারজাতকরণ সীমাবদ্ধতা, পানির প্রাপ্যতা এবং মাটির স্বাস্থ্য-সম্পর্কিত পরিবেশগত সমস্যা। বর্তমানে কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে এসব সমস্যাসহ খরা ও লবণাক্ততা উপযোগী ফসলের জাত উদ্ভাবন করার দিকে মনোযোগ দেয়া হয়েছে।

খাদ্যপ্রাপ্তির ক্ষমতা

খাদ্যের অর্থনৈতিক প্রবেশাধিকার বলতে উপার্জন ও স্থানান্তরের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় খাদ্য অর্জনের ক্ষমতাকে বোঝায়। যদিও জাতীয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং পর্যাপ্ত খাদ্য প্রাপ্যতা গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি পরিবার ও ব্যক্তি স্তরে খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের জন্য মোটেই যথেষ্ট নয়। খাদ্যের আর্থিক ও সামাজিক অধিকার অনেকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে, যার মধ্যে রয়েছে পারিবারিক উপার্জন, আয়-খরচের বণ্টন, জমি অধিগ্রহণ, খাদ্যের ব্যয় ভাগ; যা কৃষি জিডিপি ও কর্মসংস্থানে অবদান রাখে।

খাদ্যের অর্থনৈতিক অধিকার খাদ্য ও আয়ের বণ্টনের পরিবর্তনের ওপরও নির্ভর করে। ২০১০ সালে জিনি সহগের মান অনুসারে আয় বণ্টনের অনুপাত ছিল শূন্য দশমিক ৪৬। যা কিনা ১৯৮৩-৮৪ সালের শূন্য দশমিক ৩৬ শতাংশ অনুপাতের তুলনায় ক্রমাগত বেড়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে আয় বণ্টনের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। ২০০৫ সালের তথ্যে দেখা যায়, দেশে প্রায় ৯০ শতাংশ জমি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক (যাদের জমির পরিমাণ ২ দশমিক ৫০ একরের চেয়েও কম) দ্বারা পরিচালিত হয়। 

শিল্প ও সেবা খাতের উচ্চ প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও জিডিপিতে কৃষির অবদান প্রায় ১৫ শতাংশ এবং দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৪০ শতাংশের বেশি। এছাড়া বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যার খাদ্যের ওপর অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য সরকারি খাদ্য বিতরণ পদ্ধতির (পিএফডিএস) অধীনে খাদ্যশস্যকে কয়েকটি চ্যানেলের মাধ্যমে বিতরণপূর্বক দরিদ্র জনগণকে খাদ্য ভর্তুকি প্রদান করা হচ্ছে।

খাদ্যের সদ্ব্যবহার

খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা কেবল খাদ্যের প্রাপ্যতা কিংবা আর্থিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে না, বরং পুষ্টি ধারণ করার জন্য পরিপূরক শর্ত যেমন নিরাপদ পানীয় জলের প্রাপ্যতা, স্যানিটেশন সুবিধা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, মাতৃ ও সাধারণ শিক্ষার ওপর নির্ভর করে। সার্বিকভাবে সুস্থ থাকার জন্য শরীরে পুষ্টির ভারসাম্য গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে শিশুদের জন্য। বাংলাদেশে খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি সত্ত্বেও অপুষ্টির উচ্চহার এখনো বড় ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।

বাংলাদেশে অপুষ্ট শিশুদের হার কমাতে তিন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন: দরিদ্র গোষ্ঠীগুলো বিশেষ করে নারী ও শিশুদের জন্য সম্পূরক খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করা, মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ঘাটতি বিশেষ করে অপুষ্টিজনিত শারীরিক উপসর্গগুলো সম্পর্কে ধারণা দিতে পুষ্টিবিষয়ক প্রয়োজনীয় শিক্ষা ও সচেতনতা প্রদান এবং শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যের উন্নতি। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাত কর্মসূচি (এইচএনপিএসপি) দেশের অন্যতম পুষ্টিভিত্তিক কর্মসূচির একটি। জনগণের জন্য এ স্বাস্থ্য উন্নয়ন কর্মসূচিটি গৃহীত হয় ২০০৩ সালে। যার মধ্যে রয়েছে পুষ্টি, প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ সেবার মতো বেশ কয়েকটি স্বাস্থ্যসেবার প্যাকেজ।

জাতীয় পুষ্টি প্রকল্পের আওতায় কমিউনিটি

পুষ্টিকেন্দ্রগুলোতে (সিএনসিএস) শিশু, গর্ভবতী নারী, সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন মাতা ও দরিদ্র পরিবারের কিশোরীদের বিভিন্ন পুষ্টিসেবা প্রদান করা হয়। তাছাড়া সরকার ১৩,৫০০টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিবারকল্যাণ সেবা প্রদান করছে। এ ধরনের আরো ক্লিনিক তৈরির কাজ চলছে। তবে এতকিছুর পর এখনো অপুষ্টির উচ্চমাত্রা বিদ্যমান এবং সব উদ্যোগ সত্ত্বেও শিশু ও নারীদের ওপর অপুষ্টির প্রভাব অনেকটাই রয়ে গেছে।

পুষ্টিহীনতা বাংলাদেশের একটি বড় ধরনের সমস্যা। এটি মানব শরীরে নিভৃতে ক্ষতিসাধনের পাশাপাশি পূর্ণ সক্ষমতাকে গ্রাস করে। স্বাভাবিক পুষ্টিমান মানুষের তুলনায় এসব মানুষের স্বাভাবিক ও পরিপূর্ণ সক্ষমভাবে বেঁচে থাকা ও কাজ করার ক্ষমতাগুলো কেড়ে নেয় অপুষ্টিজনিত সমস্যাগুলো। শিশুদের ওপর এর প্রভাব ও পরিণতি গুরুতর এবং ভয়াবহ। কারণ জীবনের প্রথম পর্যায়ে দুর্বল ও অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুরা পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় অনেক বেশি পতিত হয়।

দারিদ্র্য ও খাদ্য নিরাপত্তা

অত্যধিক দারিদ্র্যের বিষয়টিও চিহ্নিত করা গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় জড়িত, যেমন অত্যধিক দুর্বলতা ও অপুষ্টি, অসুখের প্রকোপ বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন ধরনের শারীরিক অক্ষমতা, যা প্রায়ই অকালমৃত্যুর কারণ হয়। পরিবারের খাদ্য অনিরাপত্তার একটি প্রধান কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য। দরিদ্র পরিবারগুলোর খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করার ক্ষমতা নেই। প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবা থেকেও তারা বঞ্চিত। এমনকি দরিদ্র পরিবারগুলো যদিও কিছু পরিমাণ খাদ্য গ্রহণে সফল হয়, তবুও তাদের খাদ্য তালিকায় যে খাবারগুলো থাকে তা প্রয়োজনীয় গুণগতমানের চাহিদা ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট পূরণে ব্যর্থ হয়। অপুষ্টিতে আক্রান্ত মানুষেরা যেহেতু কম উৎপাদন শক্তিসম্পন্ন, তাই তারা ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের একটি বিপজ্জনক চক্রের মধ্যে আবর্তিত হতে থাকে। তারা প্রয়োজনীয় উপার্জন করতে সক্ষম হয় না, ফলে তারা প্রায়ই ক্রমাগতভাবে অসুস্থতা ও অক্ষমতা দ্বারা আক্রান্ত হয়। দরিদ্র পরিবারগুলোর শিশুদের জন্য এটি ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে। অপুষ্টি তাদের শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায় সৃষ্টি করে, যার প্রভাবগুলো গুরুতর ও স্থায়ী। জীবনের প্রারম্ভে তারা যে অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয় বাকি জীবনে তারা কখনই এ পুষ্টির ঘাটতিজনিত সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয় না। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা দারিদ্র্যের এ ভার বয়ে বেড়াতে বাধ্য হয়।

বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নীতি

বাংলাদেশের জাতীয় খাদ্যনীতির আওতায় খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি পরিশীলিত ও সমন্বিত পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। এতে খাদ্যের প্রাপ্যতা, প্রবেশাধিকার ও ব্যবহারের মাত্রার সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। দেশের সব মানুষের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এ নীতির প্রধান লক্ষ্য। এর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রয়েছে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবারের স্থিতিশীল সরবরাহ, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মানুষের খাদ্য অভিগম্যতা বৃৃদ্ধি এবং সবার জন্য বিশেষ করে নারী ও শিশুদের পুষ্টির বিষয়টি নিশ্চিত করা। নীতিমালায় খাদ্যের লভ্যতা, অভিগম্যতা ও পুষ্টিমানের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের দিকে বিশেষভাবে জোর দেয়া হয়েছে। তাছাড়া এটি কার্যকর খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য বহুমাত্রিক সমন্বিত ব্যবস্থার প্রয়োজনকে চিহ্নিত করে অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে তাত্ক্ষণিকভাবে খাদ্য সরবরাহের জন্য গৃহীত কর্মসূচির পাশাপাশি টেকসই কৃষি উন্নয়ন ও আয় বৃদ্ধির বিষয়গুলোর প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। জাতীয় খাদ্যনীতির সফল বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশে একটি কর্মপরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে। যার লক্ষ্য, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোকে সাহায্য করা, খাদ্য সহযোগিতার পাশাপাশি নগদ অর্থ হস্তান্তরের মাধ্যমে তাদের উৎপাদন ক্ষমতার বৃদ্ধি করা, উপার্জনে সহযোগিতা ও পুষ্টির বিষয়টি নিশ্চিত করা।

এটিও উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে সামাজিক-অর্থনৈতিক বিবিধ স্তরভেদে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈষম্য বিদ্যমান। যেমন বিনামূল্যে পুষ্টিসেবা দেয়া হলেও দেখা যায়, দরিদ্র শ্রেণীর যে মানুষগুলোর উদ্দেশ্যে সেবা প্রদান করা হয় তারা তা গ্রহণে অপারগ। বিশেষত, এ মানুষগুলোর বসবাস প্রান্তিক অঞ্চলে বা শহর থেকে দূরে কোনো নিভৃত অঞ্চলে। তাই বিভিন্ন সেবাকেন্দ্রে পৌঁছতে তারা অনেক ক্ষেত্রেই সমর্থ হয় না, কিংবা ওই সেবা গ্রহণের সুযোগও তাদের নেই। এদের অনেকেই আবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে অপুষ্টিজনিত সমস্যায় ভুগে থাকে। এ ধরনের সমস্যাগুলোকে প্রায়ই ‘নির্বাক জরুরি’ সমস্যা হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়।

শিশু অপুষ্টির ক্ষেত্রে বাংলাদেশে লিঙ্গ, ভৌগোলিক অঞ্চল এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক গোষ্ঠীভেদে বড় ধরনের বৈষম্য রয়েছে। তথ্য-উপাত্ত অনুসারে বিভিন্ন সময়ে দরিদ্রদের খাদ্য সরবরাহের লক্ষ্যে গৃহীত বিভিন্ন কর্মসূচি, যেমন ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং (ভিজিএফ), কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি কিংবা এনজিও কর্তৃক গৃহীত পুষ্টি কর্মসূচি শিশুদের অপুষ্টি হ্রাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। তাই বাংলাদেশের জন্য টার্গেটেড ও আয়-দারিদ্র্যভিত্তিক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ। পাবলিক ফুড ট্রান্সফার প্রোগ্রামের মাধ্যমে অঞ্চলভিত্তিক দারিদ্র্য ও অপুষ্ট শিশুদের হার কমাতে হবে। দরিদ্র পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি এবং মায়েদের পাশাপাশি পরিবারের অন্য সদস্যদের পুষ্টিশিক্ষা প্রদান করতে হবে।

খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে বাংলাদেশের পরিবারগুলোকে বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়। স্বতন্ত্র কিংবা সমন্বিত এ ঝুঁকিগুলো তাদের দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দেয়। খাবারের ক্ষেত্রে দুর্বলতাগুলো দুটি উপায়ে চিহ্নিত করা যেতে পারে। প্রথমত, বছরজুড়ে খাদ্যের অপ্রতুল প্রাপ্যতা। দ্বিতীয়ত, মৌসুমভিত্তিক খাদ্যঘাটতি। একটি গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের ৭ শতাংশ পরিবার নিয়মিতভাবে খাদ্য ব্যবহারের অধিকার-সংক্রান্ত সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে এ ধরনের সমস্যা ভোগ করে এমন জনসংখ্যা ৩০ শতাংশ। এদিকে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ পরিবারকে খাদ্যের নিয়মিত অধিকার নিয়ে সর্বক্ষণ ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়। তবে মাঝেমধ্যে এ সমস্যায় আক্রান্ত হয় এমন পরিবারের সংখ্যা ৩০ শতাংশেরও বেশি। খাদ্য নিরাপত্তায় টেকসই পারিবারিক জীবনযাপন কর্মসূচিতে দেখা যায়, ভূমিহীন দুই-তৃতীয়াংশের বেশি পরিবার ও প্রান্তিক কৃষির ওপর নির্ভরশীল পরিবার এবং সম্পদহীন পরিবারগুলো আশ্বিন, কার্তিক, চৈত্র ও বৈশাখ মাসে খাবারের সংকটে পড়ে। এ সময়ে যেমন তারা তিন বেলার খাবার গ্রহণে সমর্থ হয় না, তেমনি মানসম্পন্ন খাবার গ্রহণের পরিমাণও কমে যায়। তখন এ ধরনের অবস্থা মোকাবেলায় দরিদ্র পরিবারগুলো ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। অবস্থার শুরুতেই, পরিবারগুলো তাদের খাবারের পরিমাণ ও মানের সঙ্গে আপস করে। স্বভাবতই তারা কম মূল্যের ও কম পছন্দসই খাবারের দিকে দৃষ্টি দিতে বাধ্য হয়। সাধারণত পরিবারের বয়স্ক সদস্যরা, বিশেষ করে নারীরা, নিজেদের খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ কমিয়ে দেয়; যাতে করে পরিবারের পুরুষ সদস্য ও শিশুদের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার তুলে দেয়া সম্ভব হয়। দুর্ভোগ বাড়তে থাকলে পরিস্থিতিও বদলাতে থাকে এবং পরিবারের নারী সদস্যরা আরো কঠোর অবস্থার মধ্যে নিপতিত হয়। ঐহিত্যগত কারণেই আমাদের নারীরা পরিবারের বহিঃস্থ কাজের সঙ্গে কম সম্পৃক্ত। তবে এ ধরনের পরিস্থিতিতে তারা বাইরের কাজে বেশি মনোযোগ দিতে বাধ্য হয়। অনেক সময় শিশুদের স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে অর্থ উপার্জনের কাজে নিয়োগ করা হয় এবং পরিবারের পুরুষ সদস্যরা এলাকা ছেড়ে খণ্ডকালীন কাজের সন্ধানে শহর বা শহরতলিতে চলে আসে। পরিবারের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার প্রকোপ বৃদ্ধির সময়ে আরো একটি প্রবণতা লক্ষ করা যায়, তা হলো সাধারণ আত্মীয়স্বজন এবং বিভিন্ন ঋণদাতার কাছ থেকে অর্থঋণ নেয়ার পাশাপাশি অনেকে কর্মস্থল থেকে অগ্রীম বেতন তুলে নেন। কখনো এমন পরিস্থিতিও তৈরি হয় যে, অনেকে গৃহপালিত পশু অথবা জমি পর্যন্ত বিক্রি করে দেন। শিশু অধিকার সনদ অনুসারে বাংলাদেশ সরকার শিশুদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি চাহিদা মেটাতে অঙ্গীকারবদ্ধ। এছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজি অর্জনের জন্য সরকারকে খাদ্য নিরাপত্তা ও উন্নত পুষ্টির লক্ষ্য অর্জনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সরকার ইতিমধ্যেই পুষ্টি চাহিদা মেটাতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম জাতীয় পুষ্টি কর্মসূচি (এনএনপি)। যার আওতায় গোষ্ঠীভিত্তিক শিশু ও নারীদের পুষ্টি সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। তবে দেশের অপুষ্টি সমস্যা মোকাবেলা এবং ব্যাপক জনসংখ্যার পুষ্টি ঘাটতি হ্রাস করতে, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের পুষ্টি সমস্যা মোকাবেলায়, আরো বেশি উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

খাদ্য নিরাপত্তার অধিকারভিত্তিক পদ্ধতি

খাদ্য নিরাপত্তাসংক্রান্ত সমস্যাগুলোর ধরন ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় খাদ্য নিরাপত্তার অধিকারভিত্তিক পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা নীতির নকশা প্রণয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামো প্রদান করা যেতে পারে। বাংলাদেশে সাংবিধানিক নিশ্চয়তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ মোতাবেক খাদ্য নিরাপত্তার অধিকার রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক প্রতিশ্রুতি। ১৯৯৩ সালে মানবাধিকার বিষয়ক বিশ্ব সম্মেলনে বাংলাদেশ ভিয়েনা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেছে। এর মাধ্যমে দেশটি ১৯৮৬ সালে জাতিসংঘের উন্নয়নে অংশগ্রহণের অধিকারসংক্রান্ত ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাছাড়া ১৯৯৮ সালে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার-সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক চুক্তি (আইসিইএসসিআর) স্বাক্ষরের মাধ্যমে বাংলাদেশ উন্নয়নের অধিকার বাস্তবায়নে আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক অঙ্গীকার করেছে। চুক্তির ১১(২) অনুচ্ছেদ অনুসারে, চুক্তিবদ্ধ রাষ্ট্রসমূহ নাগরিকদের ক্ষুধামুক্তির মৌলিক অধিকার স্বীকার করে স্বতন্ত্রভাবে এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণসহ অন্যান্য ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অনুচ্ছেদ ১১(১) অনুসারে, রাষ্ট্রকে প্রত্যেক ব্যক্তি এবং তার পরিবারের সদস্যদের পর্যাপ্ত খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থার মাধ্যমে তাদের মানসম্মত জীবনযাত্রার বিষয়টি নিশ্চিতের পাশাপাশি জীবনমানের ক্রমাগত উন্নতির বিষয়টি লক্ষ্য রাখতে হবে। রাষ্ট্রগুলো নাগরিকদের এই অধিকার আদায় নিশ্চিতের জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লেখিত অনুচ্ছেদ ১৫ অনুসারে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন, যাতে নাগরিকদের জন্য নিম্নলিখিত বিষয়সমূহ অর্জন নিশ্চিত করা যায়— অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা।

খাদ্য নিরাপত্তার অধিকারভিত্তিক পদ্ধতি সর্বস্তরে খাদ্যের অধিকারের স্বীকৃতি, প্রচার ও সুরক্ষার জন্য স্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট মানবাধিকারের মানদণ্ড প্রদান করে। তাছাড়া একটি কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গত পদ্ধতি খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিস্তৃত নির্দেশিকাও প্রদান করে।

এক্ষেত্রে জোর দেয়া হয় খাদ্য নিরাপত্তা নীতির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ  উপাদানের ওপর, যেগুলো মানবাধিকারের শর্ত পূরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতাকে অর্জন করে এবং জনগণের খাদ্যের অধিকার লঙ্ঘন করে রাষ্ট্রকে এমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করতে বাধ্য করে। এর অর্থ, রাষ্ট্র কখনই ইচ্ছাকৃতভাবে খাদ্য নিরাপত্তা কিংবা খাদ্যের অধিকারের ক্ষেত্রে সমাজের যেকোনো প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণকে ইচ্ছাকৃতভাবে বাধা প্রদান করবে না। এই আইনি বাধ্যবাধকতার মাধ্যমে রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে যে, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর খাদ্য অধিকার নিশ্চিতের ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো পক্ষের হস্তক্ষেপ প্রতিরোধে রাষ্ট্র যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। খাদ্যের অধিকার দুভাবে নিশ্চিত করা যেতে পারে। প্রথমত, খাদ্যপ্রাপ্তির বিষয়টিকে সহজতর করা। এবং দ্বিতীয়ত, জোগান দেয়া। রাষ্ট্রের আইনগত বাধ্যবাধকতার মধ্যে রয়েছে: একব্যক্তির খাদ্য অধিকার নিশ্চিতের লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে, দুই. প্রয়োজনীয় ও গুণগত মানসম্পন্ন খাদ্য সরবরাহের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদের উৎসকে নিশ্চিত করতে হবে।

খাদ্য নিরাপত্তার অধিকারভিত্তিক পদ্ধতির মৌলিক প্রয়োজনীয়তার একটি হচ্ছে, ফলাফল উপভোগ করার পাশাপাশি প্রত্যেক ব্যক্তির নীতিমালা তৈরির প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অধিকার। প্রক্রিয়াটি ফলাফলগুলোর মতোই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অংশগ্রহণের অধিকার উন্নয়নের অধিকারের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাছাড়া এটি স্বীকৃতির প্রয়োজন রয়েছে যে, কার্যকর অংশগ্রহণের জন্য নাগরিকদের ক্ষমতায়নের প্রয়োজন। যা দরিদ্র ও বঞ্চিত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সচেতনতা তৈরি এবং অন্যান্য নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার পূরণের মাধ্যমে সম্ভব হতে পারে। বাংলাদেশের বর্তমান খাদ্য নিরাপত্তা নীতিমালা কাঠামোটি  সঠিক পর্যবেক্ষণ ও জবাবদিহিতার সমন্বয়ে গঠিত হয়নি, যার মাধ্যমে নীতিনির্ধারকেরা নিয়মিত তত্ত্বাবধানের পাশাপাশি অগ্রগতি নিরূপণের মাধ্যমে পরবর্তী কার্যক্রমকে সমন্বয় করতে সক্ষম হবেন। উপরন্তু, প্রাসঙ্গিক তথ্যের নিয়মিত ও কার্যকর প্রচার প্রক্রিয়া বিদ্যমান নেই, যা খাদ্য নিরাপত্তা প্রক্রিয়া ও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নাগরিকদের পূর্ণ অংশগ্রহণের জন্য জরুরি। তথ্যভিক্তিক নীতি নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অগ্রাধিকারগুলোর পুনর্বিবেচনা এবং কার্যক্রমের বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সঠিক দিকনির্দেশনা প্রদানের জন্য সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী, লিঙ্গবৈষম্য ও আঞ্চলিক অবস্থাভেদে আলাদা আলাদা খাদ্য নিরাপত্তা সূচকের প্রয়োজন। সরকার কতটা কার্যকর ও জবাবদিহিতার সঙ্গে খাদ্য অধিকারগুলো নিশ্চিত করছে, তা মূল্যায়নের জন্য দেশের সাধারণ নাগরিকদের এ তথ্যগুলো জানা অপরিহার্য।

জাতীয় পর্যায়ে, সংশ্লিষ্ট দায়বদ্ধতা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতিসহ খাদ্য অধিকার বাস্তবায়নের জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। পূববর্তী বিশ্লেষণটি দেখায় যে, খাদ্য অধিকারের বিষয়টি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঘোষণাপত্র, চুক্তিপত্র এবং বাংলাদেশের সংবিধানে উল্লেখ থাকার পরও মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য অসঙ্গতি বা ঘাটতি রয়ে গেছে। রাষ্ট্রীয় প্রতিশ্রুতির সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সামঞ্জস্য থাকলেও গৃহীত খাদ্য নিরাপত্তা নীতি খাদ্য নিরাপত্তা ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ফলে কার্যকর ও ন্যায়সঙ্গতভাবে দেশের সমস্ত নাগরিককে পর্যাপ্ত খাদ্য নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক নীতি ও পদক্ষেপগুলো এখন পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে সফল হয়নি। এটা সত্যি যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় খাদ্য সংকট মোকাবেলা এবং দুর্বল গোষ্ঠীগুলোর জন্য দীর্ঘমেয়াদি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষ ধরনের কর্মসূচি (এর মধ্যে সেফটি নেট অন্তর্ভুক্ত) নেয়া হয়েছে। তবে মানবাধিকারের মানদণ্ডের অধীনে রাষ্ট্র কর্তৃক প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির পরিপ্রেক্ষিতে এর সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল, যা অধিকারভিত্তিক নীতিগুলোকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত করে না। ফলে দেশের সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত প্রভাবের চেয়ে কর্মসূচিগুলোর কার্যকারিতা কম।

এ বিষয়টি চিহ্নিত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে, বাংলাদেশের উন্নয়ন প্রতিশ্রুতির সঙ্গে দেশের খাদ্য অধিকারের আদর্শগত মানদণ্ড চিহ্নিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। মানদণ্ডগুলো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে নির্ধারণের প্রয়োজন, যাতে একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা ও পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করে খাদ্য নিরাপত্তার সার্বিক মান অর্জনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কী কী লক্ষ্য রয়েছে, যা স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলকভাবে প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা সম্ভব হয়। তবে মানসম্পন্ন পর্যাপ্ত খাদ্যের প্রাপ্যতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে খাদ্য অনিরাপত্তা ও ঘাটতির কারণে বর্তমানে বাংলাদেশ এর লক্ষ্য থেকে অনেকটাই দূরে অবস্থান করছে। তাছাড়া খাদ্য নিরাপত্তার বর্তমান প্রস্তাব সমগ্র প্রক্রিয়াকে অবহেলা করে শুধু কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনের দিকে এককভাবে জোর দেয়, যার ফলে খাদ্যের অধিকারের অবিচ্ছেদ্য ফলাফলগুলো কীভাবে বাস্তবায়নযোগ্য হবে, তা অনেকটাই অনুল্লেখিত রয়ে যায়।

সুবিন্যস্ত নীতিমালা প্রয়োগের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তার অধিকারভিত্তিক পদ্ধতিটি বাস্তবায়ন কৌশল, যেমন অংশগ্রহণ, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা, সমতা, বৈষম্যহীনতা, সার্বজনীনতা ও অবিচ্ছিন্নতার মাধ্যমে বাংলাদেশ খাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করা সম্ভব। অধিকারভিত্তিক কাঠামো, যা স্বতঃস্ফূর্তভাবে দাবি করে যে ব্যক্তির ক্ষমতা ও স্বাধীনতা রাষ্ট্র এবং অন্যান্য মাধ্যমের ওপর নির্ভর করে। এছাড়া এটি শুধু অপেক্ষাকৃত ভালো ও ন্যায়সঙ্গত খাদ্য নিরাপত্তার সফল ফলাফল নির্দেশ করে না, বরং তা কীভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে, এর পাশাপাশি মানবাধিকারের মূলনীতি অনুসারে রাষ্ট্র ও অন্যান্য দায়িত্বশীল ব্যক্তি তাদের কাজগুলো ঠিকমতো পালন করছেন কিনা না, তা তদারকের অধিকার প্রদান করে।

এ ধরনের অধিকারভিত্তিক নীতি গ্রহণ খাদ্য নিরাপত্তা লক্ষ্যমাত্রাগুলো বাস্তবায়নের সম্ভাবনাগুলোকে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়ে তুলবে। খাদ্যের অধিকার যেহেতু একটি মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত, তাই এটি পূরণে রাষ্ট্রকে আর্থিক, বস্তুগত, প্রাতিষ্ঠানিক ও অন্যান্য সম্পদ বরাদ্দের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। উপরন্তু, খাদ্যের ওপর ব্যক্তির অধিকার একটি বৈধ দাবি, যা পূরণে যথাযথ সমন্বয় ও পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে উৎসাহিত করবে।

(ইংরেজি থেকে ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস)

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, আইএনএম

           সাবেক মহাপরিচালক, বিআইডিএস